আনোয়ার হাসানঃ
অনেক কিছুর সাথে পাল্লা দিয়ে বক্তার সংখ্যাও বেড়েছে। অতীতে ভালো বলতে পারেন এমন গুণীরা বক্তব্য দিলেও এখন পাতি নেতাও মাইক নেন। শব্দ চয়নে জ্ঞান নই, বিষয় সম্বন্ধে অজ্ঞ তবুও বক্তৃতা যেন দিতেই হবে তাদের। সচেতন মহলের মতে, কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় বড় নেতারা নিজের অবস্থান শক্ত রাখতে প্রতিদ্বন্দ্বি মেধাবীদের দূরে ঠেলে দিয়ে সর্বদা মাথা গুজে থাকবে এমন চামচা শ্রেনীর অজ্ঞদের দলে বেড়ায়। এদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিক ও নাগরিক নেতারা জানান, রাজনীতি চর্চা অপচর্চায় রূপ নেয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
রাজনীতিকদের মতে, এক সময়ে মানুষের অধিকারের জন্য রাজনীতিতে নাম লেখাতো মেধাবী, সৎ যোগ্য মানুষেরা। কোথাও অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতো তারা। ‘৫২’র মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ‘৫৪’র যুক্তফ্রন্ট, ‘৬৬’র ছয় দফা, ‘৬৯ এর গণঅভুত্থানে শুধুমাত্র দেশের টানেই এগিয়ে এসেছিলো ছাত্র-যুবা তথা সব বয়সী মানুষ। তখন আদর্শ ও দেশপ্রেম ছিলো বলেই ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিলো। অনেকের মতে, ‘৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত রাজনীতি ছিলো রাজনীতিকদের হাতে। এরপর পর্যায়ক্রমে তা চলে যায় ব্যবসায়ীদের কব্জায়।
সামাজিক সংগঠন আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’র সভাপতি নূর উদ্দিন আহমেদ বলেন, অতীতে মানুষের জন্য রাজনীতি আর সমাজকর্ম করতো যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষেরা। সে সময়ের বড় নেতারা পোশাক পরিচ্ছদেরও দিকেও নজর রাখতেন না। তারা সারাক্ষন মানুষের দাবি আদায়ে সোচ্চার থাকতেন। তবে পর্যায়ক্রমে রাজনীতি সুবিধাবাদিদের হাতে চলে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোতে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশী।
সচেতন মহলের মতে, রাজনৈতিক সভাগুলোতে মঞ্চে এখন অনেকে বসে থাকেন। বলা চলে গাদাগাদি করে অবস্থান নেয় বড় নেতা শুরু করে পাতি নেতা। মঞ্চে উঠার জন্য এক ধরনের প্রতিযোগীতাও দেখা যায়। একইভাবে বক্তৃতা দেয়ার জন্যও আয়োজন ও সঞ্চালকের উপর চাপ সৃষ্টি করে তারা। দীর্ঘ দিন রাজনীতির সাথে জড়িত এমন অনেকে জানান, আগে আমরা সুবক্তার বক্তব্য শোনার জন্য অপেক্ষায় থাকতাম। এখন স্বাভাবিক কথা বলতে পারে না এমন অনেকেই বক্তৃতার নামে মাইক হাতে চিল্লায়।
আওয়ামী লীগ নেতা কামাল মৃধার মতে, একসময় অধিকার আদায়ের জন্য রাজনীতি করতো। এখন পদ পদবী, টেন্ডারবাজিসহ নানা অনৈতিক সুবিধার জন্য রাজনীতিতে আসে অনেকে। তারা ফেস্টুন ব্যাণার টানিয়ে প্রচার আর মঞ্চে ভাষণ দিয়ে সার্টিফিকেট নেয়। এদের কারনে প্রকৃত রাজনীতি উধাও হয়ে গেছে বলে মনে করেন একসময়কার মাঠ কাঁপানো ছাত্র-যুবলীগের এ নেতা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এমন অনেকে রয়েছেন যারা মাইক হাতে নিয়েই চিৎকার শুরু করেন। সভার বিষয়বস্তুতে না থেকে নেতার গুনগান আর বিরোধীদের গালমন্দ করেন। কেউ কেউ মঞ্চে উপস্থিত নেতাদের নাম বলতে বলতেই কয়েক মিনিট পার করে ফেলেন। বিশ্লেষকদের মতে, বক্তার সংখ্যা বাড়লেও বক্তৃতার মান বাড়েনি।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আরজু রহমান ভূঁইয়া মনে করেন, আগে পরস্পপর শ্রদ্ধাবোধ ছিলো। এখন তা কমে গেছে। তার মতে, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন হওয়ায় অযোগ্যরা জায়গা করে নিয়েছে। কর্মী বা শ্রোতারা শুনতে না চাইলেও ওই শ্রেনীর লোকেরা তাদের গুণগান করে দীর্ঘ বক্তৃতা দেয়।
নারায়গঞ্জে দু’টি বড় দলেই এমন কয়েকজন পদবীধারী নেতা রয়েছেন যাদের বক্তৃতা শুনে মানুষ বিরক্ত হয়। ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা বক্তব্যের শুরুতেই চিৎকার শুরু করে। ছাত্র রাজনীতি দিয়ে তার শুরু হলেও রাজনীতিক পরিচয়ের চেয়ে একটি পরিবারের একান্ত অনুগত হিসেবেই তিনি বেশী পরিচিত। দলের একাধিক নেতাকর্মী জানান, তার বক্তব্যের সময় মাইকম্যানও চিন্তায় থাকেন। মাইক নষ্ট হওয়ার ভয় আর অবিরাম থুতু বের হওয়ায় মাইকম্যানের এ চিন্তার কারণ বলে জানা গেছে। একাধিকবার ক্ষমতায় থাকা একটি রাজনৈতিক দলের উপজেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পদ রয়েছে এমন একজন বক্তৃতা দিলে মানুষ শুধু হাসে। এক সময়ে ক্ষেতের বদলি শ্রমিক থাকলেও দালালি করে বর্তমানে অঢেল সম্পদের মালিক ওই নেতার কদর রয়েছে তার দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়েও। রাজনীতি সচেতন মহলের মতে, বড় রাজনৈতিক দলগুলোতে মোটেই রাজনীতি চর্চা হয় না। আগের মতো নেতা বানানোর মতো বড় মনের নেতাও আর নাই। যে কারনে চামচা শ্রেনীর লোকেরা রাজনীতিতে ঢুকে গেছে। এই চামচা শ্রেনী সারাক্ষন তাদের নেতাদের খুশী করতেই ব্যস্ত থাকে।
নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের একাধিকবারের এমপি ও বিএনপি নেতা আতাউর রহমান আঙ্গুর এর মতে, আগে হুট করে নেতা হওয়া যেতো না। একটা সময় লাগতো। তখন রাজনীতি করতো মানুষের জন্য। এখন অনেকে রাজনীতি করে ব্যবসার জন্য। তারা মনে করেন, মঞ্চে যদি বক্তৃতা দিতে না পারে তবে তার নেতা ও সাধারণ মানুষ তাকে মূল্যায়ন করবে না। এ কারনেই বক্তার সংখ্যা বাড়ছে। এ রাজনীতিকের মতে, দায়বদ্ধতা একটা বড় বিষয়। নেতা হউক সরকার হউক যদি জনগনের কাছে দায়বদ্ধতা থাকে তবে ভালো কিছু হয়।
সোনারগাঁ বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু জাফর মনে করেন, দুর্বৃত্তায়নের ফলে রাজনীতি থেকে ভালো লোকেরা সরে যাচ্ছে। তার মতে, সাংগঠনিক দুর্বলতা, অপচর্চা, অশিক্ষিত-বিবেকহীন লোকেরা টাকার জোরে রাজনীতিতে পদ পেয়ে যায়। সে কিছু না পারলেও নিজেকে জাহির করতে মঞ্চে মাইক হাতে বক্তৃতা দেয়। এ রাজনীতিক মনে করেন, রাজনীতিকে ব্যবসায় রূপ দিয়েছে কেউ কেউ। করোনা ভাইরাসের মতো দুর্যোগেও তারা থেমে নেই।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, এখনও প্রকৃত রাজনীতিক রয়েছেন। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের বলয় ঠিক রাখতে অযোগ্যদের সঙ্গে রাখেন। বাস্তব চিত্র এমন যে, মেধাবীকে প্রতিদ্বন্দ্বি ভেবে অযোগ্যদের বুকে টেনে নেয়া হয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সেইসব নেতাদের উচিত হয় শুদ্ধ রাজনীতি চর্চা করা নয়তো রাজনীতি ছেড়ে দেয়া। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, “প্রশংসার দুর্নীতিপরায়ণ প্রভাব থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়টি হলো কাজে চলে যাওয়া।”
নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক শাহীন মাহমুদ মনে করেন, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো যে যার জায়গা মতো নেই-জবাবদিহিতা নেই। এ কারনে রাজনীতির প্রকৃত সংজ্ঞা বা সংস্কৃতি খুঁজে পাওয়া যায় না। তার মতে, পদ পদবী পেতে আর বক্তৃতা দিয়ে নিজের ফয়দা লুটায় ব্যস্ত থাকে একশ্রেনীর লোকেরা। করোনা ভাইরাসের মতো মহা দুর্যোগেও তারা শোধরায়নি। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো সচেতন হওয়া।